My Attitude!

My Attitude!

Pages

My Blog List

Meet and Recognise-- I, Me and MySelf...!

@@@ ~WELCOME TO MY CYBER WORLD~ @@@











~~~ I am My Own Music, People Want to Get in Touch With Me... Play Your Lyrics By My Rhythm ~~~



Sunday, June 24, 2018

রাফখাতা ১০

১৫ ই আগষ্ট ১৯৪৭ এ মধ্যরাতে যে দুটি রাষ্ট্র জন্মলাভ করে, আমার দেশ তারই মধ্যে একটা । খুব ছোটবেলায় দেশ মানে বুঝতাম ‘খুব-কঠিন-আঁকতে এমন’ একটা মানচিত্র । বড়বেলায় বুঝলাম মানচিত্র নয় - মানুষ ,জীবজন্তু, আলো ,হাওয়া ,মাটি আর আকাশ সব মিলিয়েই স্বদেশ । কিন্তু গোলমাল করল ‘আকাশ’ শব্দটা । সব স্বাধীন দেশের একটা মৌলিক সীমানা থাকে – ভূগোল বইয়ে ওমুক দেশের সীমানা বর্ননা দাও –তে ঢের দেখেছি । আমার দেশেরও সীমানা আছে, যা টপকে এদিক ওদিক যেতে হলে সরকারি ছাড়পত্র লাগে । নদীর উদ্দাম স্রোতেও নাকি দেশের চালক বেড়া লাগিয়ে ‘জল দেব কিনা ভাবব’ বলতে পারে । কিন্তু আকাশের সীমানা ? পাখির অথবা ঘুড়ির ওড়া দেখতে গিয়ে আমার ভাবনা সেই যে ঘেঁটে গেল , আজও সরল হল না ।
১৫ আগষ্ট – তারিখটা বড্ড ঝলমলে । সোশাল মিডিয়া থেকে আনসোশাল জনতা সব্বাই তিরঙ্গা বাগিয়ে ‘কদম কদম বড়ায়ে যা...’ গায় । এইদিন সকাল হলেই মনে পড়ে আরিব্বাস, আমাদের স্বাধীনতা এসে গেছে, চল চল তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠ !
সেবারের স্বাধীনতা দিবসও একদম এরকম ছিল । ফেসবুকে ছবি পালটানো, এফ এমে দেশাত্মবোধক গান, আর স্কুলের বাচ্চাদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ‘দেশ রঙ্গিলা’ নাচ , সবশেষে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ । ‘...জয় হে’ সুর বেশ জোরালো ছিল অন্যদিনের প্রেয়ার লাইনের চেয়ে ।
কিন্তু স্বাধীনতার ৬৯ বছর পূর্তি নিয়ে জননেতার রক্তগরম বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগে হঠাৎ ক্লাস সেভেনের কুসুম কোরা যখন বিস্কুট খেতে খেতে দুম করে মাথা ঘুরে পড়ে গেল , আর জানতে পারলাম মিড-ডে-মিল বন্ধ থাকা ছুটির দিনে ওর ছোট্ট পেট কামড়াতে থাকে খুব – সেদিন আমার স্বাধীনতার স্বাদ নিমেষে পানসে হয়ে গেল ।
অথবা যেদিন ক্লাস টেনের সোমা হাঁসদা দীর্ঘ দিন স্কুল কামাইয়ের পর হঠাৎ উপস্থিত হয়ে জানিয়ে দিল ও আর পড়বে না, বিয়ের ঠিক হয়েছে আর সে খুশি খুশি বিয়েটা করছে – সেদিন আমার পায়ের শেকলের তীব্র ঝনঝনানি গোপনে টের পেলাম ।
তবে সব দিন ছবিটা একরকম থাকে না ।
মাঝেমাঝে যখন অভি সাঁতরার মত ছেলের কথা শুনি ‘পড়তে খুব ইচ্ছা জাগে, তবে বাপের সাথে খাদানের কামেও তো যেতি হবেক । তাই তিন দিন স্কুলে আইসবক, বাকি দিন কামে যাবক । হবেক লাই, দিদিমুনি ?’- তখন ভরা শীতেও আমার স্বাধীনতা দিবস মিঠেকড়া রোদ্দুর হয়ে ছুঁয়ে যায় শিরাওঠা হাতের আঙুল ।
আবার যখন চিন্তামণি হেমব্রম স্কুলের ক্যারাটে ক্লাসেই শুধু ‘দারুণ কিছু দেখায়’ না , আত্মসম্মান বাঁচাতে শিস দেওয়া ছেলেগুলোর দিকেও মোক্ষম পাঞ্চ ছুঁড়ে দেয় – সেদিন স্পষ্ট বুঝি আমার ঘাড়ের পেছনটায় ঋজুতা প্রকট হয়েছে ।
আমার কুসুম , অভি, রতন বা চিন্তামণিরা ১৫ই আগষ্টের তাৎপর্য বোঝে না, ‘স্বাধীনতা’ শব্দের মানেও জানে না । ইতিহাসে নাম্বার তুলতে যা লাগে , সেটুকুই তারা মনে রাখতে পারে না । সোজা কথায় তারা বোঝে এই দিন একটা পতাকা তোলার সাথে সাথে এক প্যাকেট বিস্কুট মিলবে । মানে ১০ টায় কাজে যাওয়ার আগে ভরপেট না হোক, পেটভরা কিছু একটা খেতে মিলবে ।
যখন একদিকে ভরপেট পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে কলিমুদ্দিন মিয়াঁর পোয়াতি বৌ প্রসবের আগেই দম শেষ করে, তখন অন্যদিকে মাংসের জাত-ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রনেতারা ত্রিশূল আর তরোয়ালের রক্তচক্ষুর আস্ফালন দেখায় , তখন আমার সত্তরটি স্বাধীনতা দিবস দেখা বুড়ো দেশ লজ্জায় চোখ মোছে ।
ইংলিশ মাধ্যমের হুঙ্কারের চোটে অবৈতনিক বাংলা স্কুলগুলো যখন ছাত্রসংকটে ভুগছে, সেইসময় খারিজি মাদ্রাসাগুলোর সুবিধাবাদী অনুমোদনের নির্লজ্জ দাবী পেশ দেখে আমার সত্তুরে স্বদেশ গ্লানির দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগান তোলা দেশেই যখন কন্যাভ্রূণ হত্যা হয়, সুজেট, জ্যোতি , অরুণাদের সম্মানহানী হয় দিনেদুপুরে, ন্যায়বিচার যখন রাজনৈতিক যুপকাষ্টে পড়ে হাঁসফাঁস করে , সোমা-রত্নাদের বাল্যবিবাহ হয়, সাড়ে তিন বছরের যোনীতে বিঁধে থাকে সাত খানা সুঁচ, ভিন জাতে বিয়ে করা অহল্যার মাথা কেটে থানায় আত্মসমর্পন করে ‘অনার কিলিং’-এর গর্বিত দাদা – তখন আমার যন্ত্রনাক্লীষ্ট ক্লান্ত স্বদেশ মনে মনে প্রাক ’৪৭ এর সংগ্রামী দিনগুলো মনে করে স্বান্তনা খোঁজে, কান্না লুকায় ।
সেই একই দেশ শিশুর মত ঝলমল করে হেসে ওঠে সাক্ষী-সিন্ধুর রুপোলী অলিম্পিক সাফল্যে , ‘ইসরো’র মুকুটে নতুন রঙিন পালকে ।
যখন আব্বাস, সাবির, আকবরদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে অর্জুন , প্রশান্ত, নবারুণ, মিলিরা ‘নির্মল বাংলা’ অথবা ‘স্বচ্ছ ভারত মিশনে’ ঝাড়ু-ন্যাতা হাতে হাত লাগায়, চারাগাছ পোঁতে পাড়ার মোড়ে, স্কুলের গেটে সুন্দর করে আলপনা দেয় – আমার স্বাধীন স্বদেশের সাদা দাড়ি তখন তৃপ্তির অশ্রুতে ভিজে যায় ।
এই যে নিতান্ত আটপৌরে আমি, চাকরিরতা স্মার্ট ফোনে মুখ ডোবানো আমি , চেনা পথের ভীরু-বোকা নিত্যযাত্রী আমি, কারু সাতে পাঁচে না থাকা পরশ্রীকাতর আমি, খানিকটা পরোপকারী আর অনেকটা স্বার্থপর জিন রক্তের কণিকায় পুষে রাখা আমি , হ্যাঁ-কে হ্যাঁ আর না-কে না বলা আমি, অন্যায়গুলোকে মুখ বুজে সহ্য করা আমি, প্রতিবাদে চিৎকার করা আমি, ভাল-থাকার মুখোশে সমস্ত খারাপকে আপ্রাণ লুকাতে চাওয়া এই আমিই যখন দোকানীর দেওয়া প্লাস্টিককে তুমুল মাথা নেড়ে ‘না’ বলি , তার অবাক দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে ফ্যাশানেব্যল পলিথিনকে হেলায় এড়িয়ে নিজের ছেঁড়া চটের ব্যাগে অথবা পুরোনো চামড়ার থলিতে জিনিস ভরি - জনমদুখিনী আমার সত্তুরে স্বাধীনতা তখন আলগোছে আমার কপালে চুমু খায় ।
এই আমিই যখন সব্জি বাজারে চড়া দাম নিয়ে ঝগড়া করি আবার মুদিখানার ভুল বিল দেখে দিব্যেন্দুদার কাছে ভুলে যাওয়া আটার দামটা তিতিবিরক্ত মেজাজেই দিতে যাই আর বড় ভালবেসে সে বলে ‘ আপনি বলেই এদ্দুর ফিরে এসে বাকি টাকা দিলেন দিদি, অন্য কেউ হলে...’ – তখন আমার ‘ডেভেলপিং ইণ্ডিয়া’ আদর করে কপালের বেয়ে আসা ঘাম আলতো হাতে মুছে দেয়।
বাসের প্রথম সীটে বসা চকমকে শাড়ি পরা আধুনিকা মা যখন ‘শ – শ’ করে জানলা দিয়েই পুত্র সন্তানকে হিসি করতে শেখায়, আর সেই বাসেরই শেষ সীটে পাঁচ বাড়ি কামিন খাটা বাসন্তী কুমারী মুড়ির প্যাকেট বাইরে না ফেলে মুঠোয় রাখে ডাস্টবিনে ফেলবে বলে – তখন সভ্যতার তুলাযন্ত্রে ‘শাইনিং ইণ্ডিয়া’ হীনতা আর স্বাধীনতার পাল্লা মাপে ।
যে বারো বছরের ছেলেটা ১৫ই আগষ্টের শুনশান দুপুরে বা ঝিরঝিরে বিকেলে অথবা ১৬ই আগষ্টের কাক ডাকা ভোরে পোলো গ্রাউণ্ডে অথবা রাস্তার ধার থেকে কুড়িয়ে নেয় ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের তেরঙা, যাতে কেউ পা না দিয়ে ফেলে তাই ধুয়ে পরিষ্কার করে তুলে রাখে ‘মুক্তাঙ্গনে’র স্যাঁতস্যাঁতে কুলুঙ্গীতে আগামী বছর ট্রাফিক সিগন্যালে ওইগুলো বেচে ‘ফিফটিন আগষ্ট মানাবে’ বলে – বুড়ো স্বাধীনতা সে ছেলের গায়ে শীতের রাতে একটা নামহীন নকশিকাঁথা ঢেকে দেয় ।
ওই যে যারা ক্রিকেট খেলায়, মাংস খাওয়ায় , পাথর ছোঁড়ায়, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সিনেমা হলে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকায় , পতাকা জাপ্টে সেলফি তোলায়, ‘করতে হয় আর করতে নেই’-এর বুদ্ধিজীবিও তর্কবিতর্কে দেশপ্রেম খোঁজে ;
অথবা যারা সীমান্ত পারে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়, নেতানেত্রীর তুমুল তর্জন-গর্জনে, রাজনৈতিক ময়দানে সত্তরটা স্বাধীন বসন্ত ধরে লাগাতার এন্টারটেইনমেন্ট উপহার দেয় – তারা কি আমাদের কুসুম কোরা, অভি সাঁতরা , চিন্তামণি হেমব্রম, বাসন্তী কুমারী, দিব্যেন্দুদা অথবা ‘মুক্তাঙ্গনে’র বাচ্চাদের কথা জানে ?
রাফখাতার পাতা ভরে ওঠে এমন সব হিজিবিজি প্রশ্নমালায় ।
উত্তরগুলোই আজ অবধি থেকে গেছে অজানা ।
কে জানে আমার সিনিয়র সিটিজেন স্বাধীন দেশ আর কত 'বড় হলে' সঠিক উত্তরটা দিতে পারবে !

রাফখাতা ৯

ঘরবন্দী আমার নেইরাজ্যের দখল নিয়েছে ভিনদেশী গন্ধ । ঝিমঝিমে ঘ্রাণেন্দ্রিয়েও দিব্যি টের পাচ্ছি লাল-নিল হাতি মার্কা চাদরে, বালিশের ঢাকায়, জামাকাপড়ের রোঁয়ায় আর হ্যাঁচ্চোর রুমালে অদ্ভূত গন্ধ । আকাশের গায়ে টক-টক গন্ধ নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেও পাই নি।
তবে জ্বরের গায়ে ঝাল-মিস্টি গন্ধটা বেশ নেশা ধরানো ।
গন্ধটা তখনও ছিল ; যখন ট্যাঁক ট্যাঁক করে ফ্রেন্ডশীপ ডে-র পোস্টারে মোবাইল উপচে যাচ্ছিল , যখন রাখীর শুভেচ্ছায় ইনবক্স ভেসে যাচ্ছিল ।
গন্ধটা এখনো আছে ; যখন বিছানার একটা কোণায় কুণ্ডলী পাকিয়ে আউড়ে যাচ্ছি "তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্ত রাতে ..."
গন্ধটা তখনো থাকে ; যখন 'কিচ্ছু ভাল্লাগছে না', 'পড়তে ইচ্ছে করছে না', 'কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ', 'লেখা আসছে না', 'ফেসবুক খুলতে ইচ্ছে করছে না' , 'ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না' - ইত্যাদি রা বেশ জাঁকিয়ে বসে আমার প্রতিটা রোমকূপে ।
বেশ বুঝছি, এ থেকে ছাড়ান নেই ।
আগের আমি হলে খুব চাইতাম, একতোড়া রজনীগন্ধা এনে কেউ ঢেকে দিক এই দমবন্ধ গন্ধকে । - আজ যে বন্ধুত্ব দিন ।
আগের আমি হলে বেশি বেশি চাইতাম , সিরাপ-ট্যাব্লেট আর থার্মোমিটারের জঞ্জাল সরিয়ে একটা গোলাপ রাখুক কেউ পাশের টেবিলটায় । - আজ যে বেঁধে বেঁধে থাকার দিন ।
এখন বোঝা-না বোঝার মাঝখানে ঘ্যান ঘ্যানে পেন্ডুলাম দশাতেও দিব্যি বুঝি রজনীগন্ধা বা গোলাপ গোছার খোয়াব সিনেমার বিষয় । বন্ধুত্ব বা রাখীর মত কোনও সুতোবাঁধা দিবস টিবসও আমার নেই । তাদের আমি কোন সুতোয় বাঁধব, যারা সময় অসময়ে জিজ্ঞেস করে 'আজ জ্বর কমেছে?' 'ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করছিস?' 'চিন্তা করিস না সেরে উঠবি।' যারা ফোন না ধরলেও রাগ না করে পালটা ফোন করে বলে 'ঘুমিয়ে পড়েছিলি?' গলায় ব্যাথা শুনে দ্রুত ব্যস্ত কণ্ঠে বলে ' তবে থাক ।'
একটা ঠান্ডা হাত যখন প্রতি সকালে তপ্ত মাথার উপর বুলিয়ে যায় চিন্তা আর যত্নের যুগপৎ স্পর্শ , একটা ঘাম-তেল-হলুদ মাখা আঁচল যখন মুখের কাছে দুধ-রুটি আর ওষুধ পথ্যির খুঁটিনাটি সাজিয়ে ধরে ঘড়ি ধরে , একটা চাপা কন্ঠ যখন যাবতীয় উদ্বেগ আড়াল করে (পাছে আমি শুনে ফেলি ) ফোনে কারুর কাছে শেয়ার করে নিজের আশঙ্কা , একটা শিরা-ওঠা-হাত যখন উদয়াস্ত মুখ বুজে একটার পর একটা কাজ করতেই থাকে , হাজার বারণ সত্ত্বেও যখন দিনে দুবার বাজার গিয়ে ফলমূল এটা সেটা কিনে আনে - তখন আমার ডিজিটাল 'ভাল লাগা'রা লজ্জা পায় খুব ।
আমি মোবাইল বন্ধ করে রাখি । তাবৎ ফরোয়ার্ডিং শুভেচ্ছার মুখের উপর সপাট দরজা দিই।
বাইরে এখন হলদে রঙের রোদ্দুর । আমার ঝিমঝিমে দৃষ্টি দিয়ে সে রোদ ছোঁয়ার আগে এই অর্বাচীন গন্ধটা থেকে মুক্তি চাই । তেল হলুদের ঘেমো গন্ধ বুক ভরে নিতে চাই । দড়ি পাকানো হাতের মোলায়েম স্পর্শ নেওয়ার আগে এক ছুটে গলা জড়িয়ে তাঁকে ঝরঝরে গলায় বলতে চাই " আমি একদম ভাল হয়ে গেছি, আজ স্কুলে যাব ।"
তাঁর ভেঙ্গেচুড়ে যাওয়া মুখের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটলে আমার রোদ্দুর ছোঁয়া সার্থক হবে ।
জ্বরবন্দীর জুবানিতে ভুল বকা বন্ধ হবে ।
সুখবিলাস যেমন সবার নয় , অসুখের বিলাসিতাও কি সবার মানায় ?

রাফখাতা ৮


১৯২৭ এবং ১৯৫৯ । দুটো সাল ।
দুটো মাইলফলক আমাদের দেশের, রাজ্যের এবং আমার মত জিয়ার নষ্ট ধড়কন শুনে আবোলতাবোল স্মৃতিচারণ করা লোকেদের ।
আকাশবানী এবং দুরদর্শন । কলকাতা ক/খ এবং ডিডি ১/ বাংলা ।
যেক'টা হাতে গোনা জিনিসের জন্য মন খারাপ লাগে মাঝেমাঝে, ছাই চাপা গুপ্তধনের অনুসন্ধানের মত করে ফেলে আসা জীবনকে হাতড়ে বেড়াই , তার মধ্যে এই দুটো জিনিস অন্যতম ।
মোবাইল, কম্পিউটার, এফ এম- এর মত শব্দেরা যখন জন্মায় নি, সেইসময় আমাদের সাদাকালো জীবনটায় যে দুটো সাদাকালো জিনিস রামধনুর রং ঢেলে সাজিয়েছিল তারা হল এই মানিকজোড়।
১৯২৭ সালের ২৬ শে অগাস্ট ১নাম্বার গারস্টিন প্লেসের একটা ভূতুড়ে বাড়িতে যখন 'কলকাতা রেডিও'-র অফিস বসল , তখন বাঙালি একচালা ছাদের উপর খালি কাপড় শুকানো আর আচার রোদে দেওয়ার বাইরেও একটা 'কাজ' পেল । বাঁশ বেঁধে অ্যান্টেনা টাঙানোর ।
ছেলেপুলের দল এর-তার বাড়ি ঢিল মেরে উপদ্রব করার বাইরেও একটা নেশা পেল - অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ভূত ধরার নেশা ।
ভূতই তো, আমি তো ছোটবেলায় রেডিওর নানা কণ্ঠের ওঠাপড়া দেখে ভাবতাম হয় ওখানে ভূতেরা কথা বলে, নয়ত মানুষের হাত পা কেটে ছোট সাইজ করে রেডিওর বাক্সে ভরে রাখা হয় ! নইলে দেখা নাই, শোনা নাই, অমন খুপরি থেকে বিচিত্র শব্দের হিংটিংছট ভেসে আসা - এ কোনও লৌকিক কাজকম্ম হতে পারে !
তখন শ্রোতাও যেমন কম ছিল, পয়সাওয়ালা লোকও ছিল হাতে গোনা । যাদের কাছে রেডিও থাকত - তাদের বাড়ি লোকে ঘটা করে দেখতে যেত । এমনই সাদামাটা ছিল সেসব দিন । ১৯৩৩ এর পর বাংলায় নিজস্ব খবর পড়া শুরু হলে পরে একে একে কলকাতা রেডিও অফিসে চাঁদের হাট বসে । কাজী নজরুল ইসলাম , বুলবুল সরকার, বেলা দে, জহর গাঙ্গুলী, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রমুখদের জাদুকাঠিতে 'আকাশবানী কলকাতা' মুখরিত হত সারাবেলা ।
তবে আমার ছোটবেলায় রেডিও 'খুলত' সকাল ৬টায় । সিগনেচার টিউন দিয়ে সে যন্ত্র যখন বেজে উঠত তখন বিছানা আটকে পড়ে থাকে ,কোন বাঙালি বাচ্চার সাধ্যি ! ঘুম ভাঙা চোখ জোর করে বন্ধ করেই পাক্কা ৪০ মিনিট বিছানায় বসে থাকা, ৬ঃ৪৫ এর দেশাত্ববোধক তিনটে পর পর গান শুনে দাঁত মাজা শুরু হত আর ৭টার 'প্রাত্যহিকি' শুনে উঁ-উঁ স্বরে নামতা মুখস্থ ! মা ডিউটির জন্য 'রেডি' হতেন প্রাত্যহিকির পরেই ।
৮ঃ৩০টার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুর শুনেই আমার চান করা, রেডি হওয়া এবং ইস্কুলের ভাত খাওয়ার নিয়ম ছিল । আর ছুটির দিনে দুপুর ২টোর খাঁ খাঁ রোদে একপশলা বৃষ্টি হয়ে ঝরত 'গল্প দাদুর আসর', অথবা ১২ঃ৩০টার 'অনুরোধের আসর' । এগুলো ছাড়া ৯০ দশকের জীবন কল্পনাই করা যেত না ।
কলকাতা থেকে অনেক দূরে থাকলেও কলকাতার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়, বরুণ মজুমদার, জগন্নাথ বসু-দের রহস্যময় কণ্ঠস্বরগুলো ।
"আকাশবানী... খবর পড়ছি..." - সাদাকালো বাক্সের ভেতর থেকে অন্তর কাঁপানো এইসব স্বরগুলো শুনেই বাঙালির দিন শুরু হত । ঘড়ি মেলানো থেকে ঘড়ি ধরে প্রাত্যহিক কাজগুলো সারা হত । বাচ্চাদের অন্তরজুড়ে গা ছমছমে গল্পগুলো, যুবাদের বুকে আরতি মুখার্জী, সন্ধ্যা মুখার্জীর সুরেলা গানগুলো তুফান তুলত সেইসব দিনে । আর ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহালয়ার ভোর । সেই ভোর এখনো আসে, তবে এফ এমের ইয়ার প্লাগে !
আজকের শিশু এন্টেনা উঁচানো কালো বাক্সের গোল নবের কান মুচড়ে শুনতে জানে না " আজকের নাটক ... চন্দ্রগুপ্ত ।"
নাহ, আজকের শুধু শিশু কেন আমাদের কাউকেই আর এসব পুরোনো কিস্যা শুনতে হবে না ।
১৯২৭ থেকে ২০১৭ অবধি নিরবছিন্নভাবে চলা 'আকাশবানী'র এই খবর পড়ার সমাপ্তি ঘটল গত ৮ই জুলাই । সরকারি ভাবে মৃত্যু হল বাঙালির গর্বিত ইতিহাসের এক অনন্য গণমাধ্যমের সংবাদ পাঠের ।
'
খবর পড়ছি...' শোনা যাবে না , শেষ খবর পড়া হয়ে গেছে ।
কারণ এখানকার প্রজন্ম রেডিও শোনে না - অতএব যুগের দাবী শোনো । চারদিকে এত বক্তা, ভয় হয় শ্রোতা নামক ক্যাটেগরিটাই আস্তে আস্তে লুপ্ত না হয়ে যায় , সময়ের দাবী মেনে ।
ঠিক একইভাবে ১৯৫৯ সালে শুরু হওয়া দুরদর্শণের 'চোখ মার্কা' লোগো এবার বদলে যাবে । যে চ্যানেলের জন্য টিভির নামই হয়ে গিয়েছিল 'বোকা বাক্স' -সেই চ্যানেল এবার স্মার্ট হওয়ার খোয়াব দেখছে ।
একটা গোল... তাকে কেন্দ্র করে দুটো অতিকায় 'কমা' পরিক্রমা করছে ... ধীরে ধীরে গোল আর দুই কমা মিলে গিয়ে চোখ হয়ে গেল --- এ দৃশ্য দেখে সেরেল্যাকের বাটি কত বাচ্চার যে খালি হয়ে যেত , কত কিশোরের হোম টাস্ক শেষ হত দ্রুত - তা ৯০ দশকের তরুণ তুর্কীমাত্রেই জানে । সেই ঐতিহাসিক 'নেত্র' যা দূরের জিনিসকে কাছের করে দেখাত - এবার পালটে যাবে । একজন বাঙালি ডিজাইনার দেবাশীষ ভট্টাচার্য্যর হাতে সৃষ্ট এই লোগো এবার বদলে যাচ্ছে । এখনকার 'দুরদর্শন'বিহীন প্রজন্মের জন্য ভাবা হচ্ছে ট্রেন্ডি লোগোর কথা ।
আমাদের কানে যা অমৃত সমান ছিল- 'মিলে সুর মেরা তুমহারা' ... 'ওয়াশিং পাউডার নিরমা'... 'হামারা কাল, হামারা আজ, বুলন্দ ভারত কি বুলন্দ তকদির,হামারা বাজাজ' ... 'ক্যায়া সোয়াদ হ্যায় জিন্দেগী মে ...ক্যাডবেরি '...হামকো পতা হ্যায় জি, সোয়াদ ভরে শক্তি ভরে পার্লে জি'...'মেলোডি খাও খুদ জান যাও'...'বুস্ট ইস দ্যা সিক্রেট অফ মাই এনার্জি' -- সেসব খলবলে বিজ্ঞাপণ গুলো আজকের দিনে অচল । দুরদর্শনের সিগেচার টিউন এখন ইউটিউব মিউজিয়ামে বন্দী !
কারণ সেট টপ বক্সের ১১৮ টা চ্যানেলের দুনিয়ায় এসব রামধনু অতীত বড্ড ফ্যাকাশে লাগে ।
ইঁদুর দৌড়ে নষ্টালজিয়ার কোনও স্থান নেই।
সেই দাবী মেনেই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পালটে যাচ্ছে দেশ, কাল, মানুষ ,ফ্যাশান এবং মানসিকতা ।
রবি ঠাকুরের রচনা রাজনৈতিক সমীকরণে ছাঁটাই হচ্ছে , স্বাধীনতা সংগ্রামীরা যুগের দাবীতে 'টেররিস্ট' / 'এক্সট্রিমিস্ট' হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছেন , সমাজ সংস্কার আন্দোলনের রূপকারদের নামের দখল নিচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের কাট আউট ।
দেশ পাল্টাচ্ছে ।
দেশ আধুনিক হচ্ছে ।
সরকার বদলানোর সাথে সাথে আমাদের ইতিহাসের সোনালী দিনগুলো পালটে যাবে এক এক করে ।
গর্বের ঐতিহাসিক মুকুট খুলে হাল ফ্যাশানের প্যাশনেট ফাঁসে নবীন প্রজন্ম আহ্লাদিত হবে । আমাদের কথা বলার স্টাইল, হাঁটাচলার স্টাইল, পোষাকের স্টাইল, কান্না হাসির স্টাইল - সব এক এক করে ফ্যাশানেব্যল হবে , পালটে যাবে সবকিছু।
শুধু পাল্টাবে না -- সমাজের জগদ্দল নিয়মগুলো,
নারী-শিশু রক্ষার জন্য 'অধিকার চাই' এর দাবীগুলো ,
ধর্ষণের জন্য কার্য কারণ গুলো,
আমাদের দিদিমাদের বলা 'করতে হয় আর করতে নেই' এর শেকলগুলো,
ধর্ম নিয়ে খাওয়াখাওয়ি গুলো,
উচ্চবিত্ত থেকে অন্ত্যজ শ্রেনী অবধি প্রতিটা লোমকূপে আটকে থাকা প্রচলিত সংস্কার এবং কুসংস্কারগুলো ।
তারা পরম্পরার নামে 'আধুনিক' সমাজের বুকে টিকে থাকবে ,
অনুশাসনের নামে 'আধুনিক' চিন্তাদের চোখ রাঙাবে , প্রতিষ্ঠার নামে শাসনে আর শোষনে জর্জরিত করবে স্বাধীনচেতা মস্তিষ্ককে ।
আমার রাফখাতা 'পাল্টে যাওয়া', 'পাল্টি খাওয়া' আর 'পরিবর্তন হওয়া' শব্দেগুলোর তফাৎ খুঁজে হিজিবিজি কাটে দিবারাত্র । চোখের সামনে একের পর এক নষ্টালজিয়ার খণ্ডচিত্র ফুটে উঠে আমায় আন্দোলিত করে তুমুল । বড্ড চিৎকার করতে ইচ্ছে হয় 'আধুনিকতার খোলস তো পালটে ফেলা গেল, মাথার কোষগুলো পাল্টাবে কবে ?'
অস্থির অন্ধকারে কেউ যেন টুটি টিপে ধরে, বোবায় ধরা আমায় নিয়ে আমি এক অসম ছায়াযুদ্ধে হাঁপিয়ে উঠি একসময় । আর চেয়ে চেয়ে দেখি নিস্ফল আক্রোশে আমার রাফখাতার পাতারা উড়ে যাচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময় ।

রাফখাতা ৭


- আজকের মত এটুকুই । এখন পড়ার ছুটি , একটা গল্প বলব আজ । বেশ কয়েক বছর আগের কথা । আমাদের পাশের জেলা পুরুলিয়া , চেন তো ? হারান আর মিনুর মামারা নাকি থাকেন ওখানে , তাই না !
-
হ্যাঁ মিস ।
-
জানো তো, সেখানে ওদের মামারাই শুধু থাকেন না । সেখানে থাকে মুক্তি মাঝি, সঙ্গীতা বাউড়ি, বীনা কালিন্দী, আফসানা খাতুন ,সুনীতা মণ্ডল এর মত সাহসী মেয়েরা । কেন সাহসী জানো ? আমাদের স্বপ্না বাউড়ি যা করতে পারে নি, ওরা তাই করে দেখিয়েছে । ওদের সবার ইস্কুলে পড়াকালীন বিয়ে হয়ে যেত , যদি না ওরা প্রতিবাদ করত । তোমাদের মত বয়সে ওদের বাড়ির লোক ওদের চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী লোকের সাথে বিয়ের ঠিক করে । ওরা যে পড়াশুনায় খুব ভাল ছিল সবাই, তা নয় মোটেই। কিন্তু পড়া এবং স্কুলের প্রতি ওদের ভালবাসা ছিল খুব । সেইজন্য বাবা-মা যখন জোর করে ওদের বিয়ের ঠিক করল ওরা প্রবল জোরে মাথা নেড়ে 'না' বলল । বাবা-মা ওদের ঘরে তালা মেরে আটকে রাখল । সেখান থেকে অনেক কষ্টে ওরা বই-খাতা ব্যাগে ভরে রাতের আঁধারে পালাল । পুলিশের কাছে খবর দিল , নিজেদের বাল্যবিবাহ আটকালো - সে এক বিশাল কান্ড !
তারপর একদিন তারা রাষ্ট্রপতির কাছে সম্মানিত হল, কত লোক তাদের পাশে দাঁড়ালেন, সংবর্ধনা দিলেন - ওদের বিয়ে আটকে গেল । সবাই আবার স্কুলে গেল । হয়তো তাদের আগামী কাল কেউ কৃতী ছাত্রী বা বিখ্যাত কেউ হিসেবে মনে রাখবে না , কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার ইতিহাসে তাদের নাম খোদাই হয়ে গেল । এই সবই শুধুমাত্র পড়াশুনাকে ভালবেসে তারা করেছে , কেউ তাদের উস্কায়নি , কেউ তাদের মুখে ভাষা যোগায় নি । এদের থেকে শুধু ছোটদের শেখার আছে তাই না, আমাদের সব বয়েসের মানুষের শেখার আছে । তাই না !
হাঁ করা মুখগুলোর সামনে যখন বক্তব্য শেষ করলাম দেখি অনেকের চোখ চকচক করছে । ফার্স্ট পিরিয়ড শেষ হতে তখনো পাঁচমিনিট বাকি । গতকালের কাজগুলো শেষ করতে দিয়েছিলাম , কেউ করে নি । আজ বললাম ' কি হতে চাও' এক লাইনে লেখ । ওরা খাতা কলমে দাগ টানল, কেউ কেউ পেন চিবালো , কেউ বা জানলা দিয়ে বাইরের ঝাপসা আকাশে চেয়ে কিছু ভাবল ।
ইতিমধ্যে ক্রিং ক্রিং বেল পড়ল !!
খাতা টেনে নিয়ে দেখি বেশীরভাগের উত্তর ___________ । বেবাক ফাঁকা !
- "কি হল, কে কি হতে চাও সেটুকুই তো লেখার । বড় হয়ে কেউ কিছু হতে চাও না?"
থার্ড বেঞ্চের মাঝের জন উশখুশ করছে দেখে তুললাম । নাহ, সে জবাব দেয় নি, টয়লেট যাওয়ার অনুমতি চেয়েছে । আরও বার দুয়েক তাড়া লাগাতে ছেলেদের সেকেন্ড বেঞ্চ থেকে উত্তর এল ''কিছু না । বাড়ি থেকে যা বলবে ।'
দুজন মেয়ে শুনে হেসে ফেলল । তাদের দাঁড় করাতে জবাব পেলাম " আর দুটা বছর ইস্কুলে , তারপর বিয়া ।"
- সেকি ! বিয়ে করবে ? কেন ? এই যে বীনা কালিন্দীর গল্প বললাম, অল্প বয়েসে বিয়ে করলে কত সমস্যা হয় জানো না ? সেদিনও এই নিয়ে বলেছিলাম ...তাছাড়া তোমাদের পড়ার জন্য শিক্ষাশ্রী , কন্যাশ্রী প্রকল্প হয়েছে । সরকার থেকে পড়ার সুবিধা পাচ্ছ, তবে পড়বে না কেন ?
- "
পড়ে কি হবেক মিস, বিয়া তো হবেকই একদিন । উই ট্যাকা গুলান জমাইলে খরচা উঠবেক । তার লেগ্যে স্কুলে পাঠাইচ্ছে ..."
মেয়েটি আরো কি কি সব বলে গেল, আমি স্থবির হয়ে চেয়ে রইলাম । আরো অনেকে ওই মেয়ের সাথে নিজেদের বিয়ের প্ল্যান শোনাল । মিনিট পনের এভাবেই বোবা দৃষ্টি নিয়ে কাটালাম । বাইরে তখন অন্য ক্লাসের স্যার দাঁড়িয়ে !
এদিকে আমার সামনে বসে যারা এতক্ষণ উজ্জ্বল মুখে পুরুলিয়ার লড়াকু মেয়েদের গল্প শুনছিল , তারা কি সহজে সটান দাঁড়িয়ে বলে দিল ' পড়ে কি হবে ? বিয়ে তো করতেই হবে একদিন !'
শিক্ষকদের উৎসাহ অনেক খাদের কিনারায় পৌঁছানো বাচ্চাদের নাকি টেনে তুলেছে, গল্পে তো তাই জেনেছি । বাস্তবেও যে দেখি নি তা নয় । তবে কিসের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে আমাদের বেলায় ? স্বেচ্ছায় , খুশি খুশি তারা বাল্যবিবাহে সায় দিচ্ছে যেখানে , সেখানে আইন করে , পুলিশ ডেকে, ধমকে চমকে, বুঝিয়ে বা ভয় দেখিয়ে কেই বা আলোর রাস্তায় আনতে পারবে ওদের !
একটা আফসানা খাতুন যা পেরেছে , একটা মুক্তি মাঝি যা করে দেখিয়েছে - একই বাংলার জল হাওয়ায়, একই রকম মিড-ডে মিল খেয়ে, শিক্ষাশ্রী - কন্যাশ্রীর সম পরিমান অনুদান পেয়ে , একই অভাব আর কুসংস্কার আক্রান্ত পরিবেশে বেঁচে আমার রাখি, বীনা, সুমিতা, কুসুম , কিম্বা হারান , বিনয়, গৌরবরা কি ইতিহাস গড়তে পারে না !
শ্লথ পায়ে আমি ক্লাসরুম ছাড়ি , সেকেন্ড পিরিয়ডে আরো কিছু বয়ঃসন্ধির কাঁচাপাকাদের আড্ডায় এগিয়ে যাই ।
পেছনে সামনে কচি কচি মুখগুলো ঘুরে বেড়ায় , যাদের মস্তিষ্কের কোষে কোষে 'মেয়েদের এটা করতে হয়, এটা নয়', 'নারী জন্মের আসল সার্থকতা মাতৃত্বে' আর 'বিয়েতেই মেয়েদের মুক্তি' - নামক ঘুণপোকাদের বাস ।
তাদের সামনে কোনও আদর্শ নেই, জীবন গড়ার লক্ষ্য নেই ।
কোনো রেখা কালিন্দীর প্রতিবাদের গল্প তাদের জানা নেই । জানলেও পাত্তা দেওয়ার ইচ্ছে নেই । রূপকথার গল্প শুনেও তাদের হাই ওঠে । কোনো গৃহবধূ পণের জন্য খুন হলে, কোনো মেয়ে মোলেস্টেড হলে তাদের মনে হয় সেই মেয়েরই দোষ ছিল - ' কেন দেয় নি টাকা ?' ' কেন গেছিল রাত্রে একা ? বেশ হয়েছে !'
এই আমার স্বাধীন ভারতের আগামী প্রজন্ম - এই আমার আগামীদিনের 'শাইনিং ইণ্ডিয়া' । এদের পড়াবার লক্ষ্যেই আমার ,আপনার ,আমাদের সবার দিন শুরু হয় ।
হ্যাঁ আমরা পড়াই । প্রতিটা দিন , প্রতিটা ক্লাসে নরমে গরমে পড়াই আমরা ।
প্রতিটা দিন ভাবি আজ বোধহয় একটা শিবনাথ সোরেন দুর্দান্ত কিছু লিখবে , কারণ কাল তার চকচকে মুখে অনেক ভাবনা খেলতে দেখেছি ।
কিন্তু প্রতিটা দিন আমি ভুলে যাই, সিলেবাসের যেমন নির্দিষ্ট পরিধি থাকে , মোটিভেশানেরও তেমনি গড় আয়ু থাকে... ৩০ মিনিট ।
আমার নাছোড় ছায়াসঙ্গী রাফখাতাটা অলক্ষ্যে দেখে আমার হেরে যাওয়ার এক একটা দিন ।
এক একটা যন্ত্রণা সে নীরবে লিখে রাখে ব্যর্থতার হিজিবিজি আঁচড়ে ।
প্রতিটা সকাল সেই আঁচড়গুলোয় আঙুল বোলাই, আর আবারও আশায় বুক বাঁধি কোনও এক সঙ্গীতা বাউড়ির দেখা পাব বলে ।

রাফখাতা ৬


বেলা ১১টার আকাশটা যে এমন ভাবে ডুকরে কেঁদে উঠবে - কেই বা জানত ! সারা রাত বিলাপ , ভোর রাতে প্রলাপ এবং দিনভর কালি ফেলা চোখে তার গোমড়াথেরিয়াম মুখ দেখেই বুঝেছিলাম ঝেঁপে কান্না আসবে । এলোও নিয়ম মত । কিন্তু শহরের ব্যস্ত ট্রাফিকে পেশাদার নাগরিক সমাজকে ত্রস্ত করেই এলো । ওয়াইপারের স্পীড যখন লো থেকে হাই করে ফেলতে বাধ্য হলাম , তখন 'শাওন গগনে ঘোর ঘন ঘটা'র মূহুর্মূহু তর্জন গর্জন । এরমধ্যেই হঠাৎ একটা ছবি আমায় টাইম মেশিনে চাপিয়ে এক আলোকবর্ষ পেছনে নিয়ে গেল ।
লাল টুকটুক রেনকোটে ঢাকা সাড়ে তিন ফুটের এক সিল্যুয়েট ! পাশে তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে বাবা । রেনকোটের পেছনের উঁচু পিঠ জানান দিচ্ছে মা সরস্বতীর বরপুত্র না হোক, বিদ্যে বোঝাই ছোটবাবু তো বটেই !
রেনকোট ... আমার ৪২ টা জলের বোতল আর ২১ টা পেন্সিল বাক্স হারিয়ে যাওয়া প্রাইমারি স্কুল জীবনের সাক্ষী । উষাগ্রাম গার্লসের সেইসব পাশ-ফেলের দিনে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে যে জিনিসটা ঠিক সময় মত স্কুল ব্যাগে ঢুকে যেত , তা হল ওই রেনকোট । রুটিন অনুযায়ী বইখাতা নিতে ভুল হলেও ,ওইটা নিতে ভুলতাম না।
একটা ধারণা , যা অঙ্কে ভোঁতা মাথায় ভয় ধরিয়ে দিত তা ছিল ' নিজে ভিজলে ক্ষতি নেই । কিন্তু বইয়ের ব্যাগ ভিজলে মা সরস্বতী পাপ দেবে , এবারের অ্যানুয়ালে ডাহা ফেল !'
ডাক-ব্যাকের মোটা নেভি ব্লু রেনকোট যা ওই তিন ফুট হাইটের আমার হাঁটুর নিচ অবধি ঝুলত, তাকে ধরে পাকড়ে , টেনে টুনে গোড়ালি অবধি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলত ঝমঝমে শ্রাবণের বিকেলগুলোয় । বই ভিজলে পাপ, আর জুতো ভিজলে সর্দি-জ্বর-মার খাওয়া -- তবে কোনটার ইম্প্যাক্ট যে বেশি সেইটা ভাবতে ভাবতে আর এই টানাটানির চোটে পিঠের উঁচু মতন বিদ্যে-ঢাকা-অংশটা প্রতিবারই ফেটে যেত । ফলে ভেজা সরস্বতী নিয়ে পরীক্ষায় পাশ-ফেলের টেনশানটা রয়েই যেত । সেটা আরো বেড়ে যেত মলাট দেওয়া খাতার মাঝের পাতা ছিঁড়ে নৌকা বানানোর সময় । বিশেষত সেই খাতা যদি ভূগোল কিম্বা অঙ্কের হয় !
কিন্তু রেনকোট পরে কাগজের নৌকা না বানালে তো ক্লাস ফোরের মানইজ্জত থাকে না , বিশেষত সেগুলো যখন বাস থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে নুনীয়া নদীতে ফেলার প্রতিযোগীতা চলে । সেই প্রতিযোগীতায় হার -জিত নেই, কিন্তু নাম না দিলে প্রস্টিজে গ্যামক্সিন ! হেরো পার্টি ।
পূর্ণিমার বোন কৃষ্ণাকে দেখতাম জুতোজোড়া খুলে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকত স্কুল গেটের ধারে ।
-'
কিরে, এভাবে কেন দাঁড়িয়েছিস ? জুতো কই ?' - উত্তরে কান এঁটো করে হেসে সে বলত , 'রেনকোটে ব্যাগেল ভেতল ।'
আমরা কপালে চোখ তুলে যখন বইখাতার সাথে জুতোর সহাবস্থান নিয়ে হাঁ- হাঁ করে হাত পা নেড়ে কিছু বলতে যেতাম , তখন ও বেমালুম বলে ফেলত ' জুতো ভিজলে ইস্কুলে আসব কি কলে ? পলিক্ষা দেব কি কলে ? তাই পেলাস্টিকে ঢুকিয়ে অন্য খোপে ভোলেচি । আমাল ব্যাগে দুটো খোপ , জানো ! ' - আমরা বেকুব বনে ঢোক গিলতাম।
সত্যি তো, এইটা তো মাথায় আসে নি । ছোটরা এভাবেই চমকে দিয়ে সমীহ আদায় করে নিত । ভাগ্যিস রেনকোট ছিল ! বড়দের জলের ছিটে বাঁচানো সন্তর্পণ হাঁটাচলা অথবা ছাতার গাম্ভীর্যকে কাঁচকলা দেখিয়ে দেখিয়ে জল ছপছপ করে দৌড়ে যাওয়া যেত বৃষ্টির পরোয়া না করেই ; ' বৃষ্টি আমায় ধরতে পারে না ' - বলতে বলতে ।
হাই স্কুলের উঁচু ক্লাসে যখন হাইটের সাথে ব্যাগের ওজন বাড়ল, তখন রেনকোট ভরার জায়গাটা হাত বদলে নিয়ে নিল ছাতা । নাহ, ছাতায় মাথা ঢাকা গেল ঠিকই, তবে রেনকোটের বাহারি কুঁজওয়ালা আভিজাত্য রইল না ।
ঠিক যেমনভাবে জলের গেলাসের (কারু মতে গ্লাস) আভিজাত্য কেড়ে নিল প্লাস্টিকের ব্যস্ত বোতল । সেই জমিদারও নেই, সেই জমিদারিও নেই - বংশের কুলীনতা বলতে ডি এন তে কিস্যু নেই । তবু যখন পঞ্চব্যঞ্জ বেষ্টিত থালা-বাটির পাশে রাখা লতাপাতার কাজ করা বাহারি জগের ছুঁচালো মুখ থেকে বর্ণহীন পানীয়টি ধারা বেয়ে নেমে পড়ত গেলাসে - তখন হু-হু তৃষ্ণাটা আচানক বেড়ে যেত । হোক না তারা স্টিলের , কাঁসার বিলাসিতা নাই বা থাকল তবু জল , জগ, গেলাস - সমার্থক ছিল সেই সময় । রেনকোটের মত গেলাসেরও একটা আলাদা সম্মান ছিল । এখন অতিথিদের জন্য গেলাস তোলা থাকে কাঁচের কুলুঙ্গিতে - তাকের শোভাবর্ধনই যার প্রাত্যহিক কাজ । তাকের ভেতর থেকে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে রঙিন প্লাস্টিক বোতলের দিকে ।
বাঙালি পেশাদার হোক না হোক , কিন্তু যেই না যেমনতেমন পেশায় ঢুকল অমনি সে ভয়ানক ব্যস্ততার মুখোশে ঢাকা পড়ল । আর ব্যস্ততার অছিলায় বোতল গেলা শিখল । এখন স্কুলের বাচ্চাদেরও বোতলে মুখ । ঠিক যেমন রেনকোটের জায়গায় তারা ছত্রধর হতে স্বচ্ছন্দ্য । ইঁদুর দৌড়ে তারাও মারাত্মক ব্যস্ত কিনা !
গেলাস আকারের ঢাকনা আঁটা জলের বোতল, যাতে জল ঠাণ্ডা থাকে -সেসব কুলীন পাত্র এখন মিউজিয়ামে অথবা গিফট কর্নারে দ্রষ্টব্য । সবাই এখন বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢকিয়ে 'তেষ্টা' মেটায় । কিন্তু চুমুকের 'তৃষ্ণা' মেটে কি !
এমনিভাবে হারিয়ে যাওয়া টিনের বাক্স, হলুদ- সবুজ ফিতে , ব্যাঙ্গাচি খোঁচানো বিকেল , রেনিডে-র ইচ্ছেকৃত ভেজানো স্কুল ড্রেস , ব্যাঙের ছাতার নিচে একবার অন্তত মাথা গলাবার আপ্রাণ চেষ্টা , ফার্ণ মস এবং অন্যান্য শ্যাওলাদের নিয়ে জীবনবিজ্ঞান বই মিলিয়ে বিস্তর গবেষণা, ঘাস ফড়িং ও সূঁচ ফড়িঙের লেজে লেজে সুতো বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া অথবা লন্ঠনের তাপে ভেজা বই শুকানোর আষাঢ়ে দিনগুলো নিয়ে রাফখাতার পাতায় কাটাকুটি খেলতে খেলতে বৃষ্টি দেখি ।
রেনকোট হোক বা জলের গেলাস - যা কিছুই হারানো অতীত , তাই নিয়েই আমার রাফখাতা জলকেলি শুরু করে ।
তারই মধ্যে কখনোসখনো যখন এক ভেজা চড়ুই গা ঝাড়া দিয়ে জানলার গ্রিলে ঠেস দেয়,
অথবা পথ ভুলে কোনো এক বেজোড় শালিক ভেন্টিলেটরের অতিথি ফুড়ুৎ এর সাথে ঝগড়া করে , অথবা ব্যালকনির পাতাবাহারের লালচে পাতাগুলো জলের ছিটেতে স্নান সারে ,
তখন বড় গোপনে টের পাই , আমার রিক্ত মনের আনাচ কানাচও আমূল সিক্ত হচ্ছে ।
বাইরের কালো আকাশে তখন 'গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে '
আমি জানলাটা হাট করে খুলে দিই । বৃষ্টি ছুঁই ।